২০২৫ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একের পর এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড ও বিপর্যয়ের শিকার হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রগুলোতে এই ধারাবাহিক আঘাতের ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। দেশের সাধারণ মানুষের মনে আজ একটিই প্রশ্ন: এটা কি শুধুই ভয়াবহ দুর্ঘটনার এক অবিশ্বাস্য সমাপতন, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র?
এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন বিশ্লেষণ এক উদ্বেগজনক সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন এই ঘটনাগুলো আসলে দেশের অর্থনীতির ওপর একটি সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত হামলার অংশ হতে পারে। এই লেখায় আমরা সেই যোগসূত্রগুলো উন্মোচন করব এবং দেখাব কীভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরি করে।
১. আঘাতের ধরন: এক সপ্তাহে দেশের অর্থনৈতিক হৃৎপিণ্ডে বারবার হানা
এই অর্থনৈতিক হামলা শুরু হয়েছিল ১৪ই অক্টোবর, এবং পরবর্তী দিনগুলোতে তা দেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত খাতগুলোর ওপর যেভাবে আঘাত হানা হয়েছে, তা এক ভয়ংকর পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। ঘটনাগুলোর ক্রম এবং লক্ষ্যবস্তু বিশ্লেষণ করলে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা নকশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
- অক্টোবর ১৪: মিরপুরে একটি পোশাক কারখানা এবং সংলগ্ন রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এই আঘাতটি সরাসরি দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত, পোশাক শিল্পের ওপর করা হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং কারখানাগুলোর নিরাপত্তা সার্টিফিকেশন হুমকির মুখে পড়ে, যা রপ্তানি আয় কমার সরাসরি কারণ হতে পারে।
- অক্টোবর ১৭: চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (EPZ)-তে আগুন লাগে। ইপিজেড হলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি সুরক্ষিত কেন্দ্র। এমন একটি নিরাপদ স্থানে অগ্নিকাণ্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে এবং একটি বার্তা দেয় যে, বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা নিরাপদ নয়।
- অক্টোবর ১৮: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যা ছিল আর্থিকভাবে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানি করা কাঁচামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
- অক্টোবর ১৮: ঠিক একই দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে বঙ্গোপসাগরে রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী একটি জাহাজ ডুবে যায়। এই ঘটনাটি দেশের লজিস্টিকস এবং শিপিং সক্ষমতার ওপর সরাসরি আঘাত।
- অক্টোবর ১৯: ধামরাইয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানায় আগুন লাগে। ইনসেপ্টা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এই ঘটনাটি একটি উচ্চ-মূল্যের এবং অত্যাধুনিক রপ্তানি খাতকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে, যা প্রমাণ করে হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল বহুমুখী।
এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই রপ্তানি-সম্পর্কিত শিল্পকে লক্ষ্যবস্তু করা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ। এগুলোকে কি শুধুই দুর্ঘটনা বলা যায়, নাকি প্রতিটি আঘাতের লক্ষ্যবস্তু ছিল পূর্বনির্ধারিত?
২. আসল লক্ষ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: একটি ‘দ্বিমুখী ক্ষতি’র কৌশল
বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই ধারাবাহিক হামলার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আঘাত হানা। বৈদেশিক রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন, যা দিয়ে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করা হয়। এই রিজার্ভকে দুর্বল করার জন্য একটি ‘দ্বিমুখী ক্ষতি’ (double loss) কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
- প্রথমত, যে কাঁচামালগুলো দেশ ইতোমধ্যে তার রিজার্ভের ডলার খরচ করে আমদানি করেছে, সেগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া।
- দ্বিতীয়ত, রপ্তানিমুখী কারখানা, পণ্য এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে দেশের নতুন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেওয়া।
বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড এই কৌশলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেখানে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই পণ্যগুলো সাধারণ কোনো পণ্য ছিল না; এর বেশিরভাগই ছিল পোশাক ও ওষুধ শিল্পের জন্য আমদানি করা অতি জরুরি কাঁচামাল। এমনকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা বিশেষ সরঞ্জামও এই আগুনে পুড়ে যায়। অর্থাৎ, দেশ ডলার খরচ করে যা কিনে এনেছিল, তা তো ধ্বংস হয়েছেই, আবার সেই কাঁচামাল ব্যবহার করে যে রপ্তানি পণ্য তৈরি হতো এবং নতুন ডলার আসতো, সেই পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এটি একটি নিখুঁত অর্থনৈতিক চোরাগোপ্তা হামলা: একদিকে দেশের সিন্দুকে থাকা সম্পদ ধ্বংস করা, অন্যদিকে সেই সিন্দুক নতুন করে ভরার পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া।
৩. বিমানবন্দরের বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন: নিখুঁত নিরাপত্তা রেটিং-এর এক সপ্তাহ পরেই বিপর্যয়
বিমানবন্দরের ঘটনাটি এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আরও জোরালো করে তুলেছে, কারণ এর পেছনের প্রেক্ষাপটটি অবিশ্বাস্য।
এই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের মাত্র এক সপ্তাহ আগে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (DFT) থেকে ১০০-তে ১০০ নম্বর পেয়ে একটি নিখুঁত রেটিং অর্জন করে। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। এই স্বীকৃতির ফলে ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি কার্গো পাঠানোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা উঠে যায়। এর অর্থ ছিল, রপ্তানিকারকদের আর ভারত বা অন্য দেশের মাধ্যমে ব্যয়বহুল ট্রান্স-শিপমেন্টের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এটি ছিল দেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং জাতীয় গর্বের জন্য এক বিরাট বিজয়।
এখানেই জন্ম নেয় বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন: যে স্থাপনাকে মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য বিশ্বজুড়ে পুরস্কৃত করা হলো, যার সাফল্যের ആഘോഷের রেশ কাটতে না কাটতেই, সেই স্থাপনার হৃৎপিণ্ড কীভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেল? এই বৈপরীত্য কোনো দুর্ঘটনা তত্ত্বকে দাঁড়াতে দেয় না।
৪. অবিশ্বাস্য ব্যর্থতা নাকি ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা?
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, বিমানবন্দরের আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল ব্যর্থতা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার দিকে ইঙ্গিত করে।
- জানা যায়, বিমানবন্দরের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করেনি।
- বাইরে থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোকে আগুনের সবচেয়ে কাছের গেট, অর্থাৎ ৮ নম্বর গেটে আটকে দেওয়া হয়, কারণ গেটটি তালাবদ্ধ ছিল।
- অভিযোগ রয়েছে যে, ফায়ার সার্ভিসের ক্রুদের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে বাধ্য করা হয়। একটি ভয়াবহ আগুনের ক্ষেত্রে এই সময়টি অনন্তকালের সমান, যা একটি ছোট আগুনকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
- কিছু বিবরণ অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে উপস্থিত বেসামরিক নাগরিক এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা যখন নিজেদের উদ্যোগে পণ্য বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন তাদেরও বাধা দেওয়া হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেই মনে করেন, এই বিলম্ব এবং ব্যর্থতাগুলো ছিল ইচ্ছাকৃত। তাদের মতে, ফায়ার সার্ভিসকে যদি সাথে সাথে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো, তবে বিপুল পরিমাণ পণ্য বাঁচানো সম্ভব ছিল। অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, কেউ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে চেয়েছিল “সর্বোচ্চ ধ্বংস নিশ্চিত করতে” বা আগুনকে “পুড়তে দিতে”।
৫. এই বিশৃঙ্খলায় লাভ কার?
যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই ঘটনাগুলো একটি পরিকল্পিত হামলা, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কাদের লাভ? সূত্রগুলো কয়েকটি রাজনৈতিক তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করে।
- একটি তত্ত্ব অনুসারে, ক্ষমতাসীন সরকার নিজেই দেশে একটি সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অজুহাত খুঁজতে পারে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করতে পারে।
- আরেকটি তত্ত্ব বিরোধী দলের দিকে আঙুল তোলে। ক্ষমতাচ্যুত শক্তি (বিএনপি) দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে প্রমাণ করতে চাইতে পারে যে, বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ। এর মাধ্যমে তারা জনগণের সহানুভূতি অর্জন করে ক্ষমতায় ফেরার পথ তৈরি করতে পারে।
- তৃতীয় একটি তত্ত্ব আরও জটিল এবং গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে হতাশ বিএনপির কিছু অংশ—বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর মতো অন্যান্য বিরোধী শক্তির সাফল্য দেখে যারা নিজেদের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান—এই চক্রান্তে লিপ্ত থাকতে পারে। অভিযোগ করা হয়, এই অংশটি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরে থাকা দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য এই হামলাগুলো চালিয়েছে।
উপসংহার
এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক স্তম্ভগুলোর ওপর এই ধারাবাহিক আঘাতের ধরণ, বিমানবন্দরের নিখুঁত নিরাপত্তা রেটিং পাওয়ার পরপরই সেখানে ঘটা বিপর্যয় এবং আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ব্যর্থতা—এগুলো কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। উত্তরহীন প্রশ্নগুলো এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
এই লেখাটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নয়, বরং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য। প্রশ্নটি সহজ: যখন একটি দেশের ভিত্তিই আগুনে পুড়তে থাকে, তখন সেই আগুন নেভানোর জন্য কার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়?
- 0Email
- 0Facebook
- 0Twitter
- 0Pinterest
- 0LinkedIn
- 0Like
- 0Digg
- 0Del
- 0Tumblr
- 0VKontakte
- 0Reddit
- 0Buffer
- 0Love This
- 0Weibo
- 0Pocket
- 0Xing
- 0Odnoklassniki
- 0WhatsApp
- 0Meneame
- 0Blogger
- 0Amazon
- 0Yahoo Mail
- 0Gmail
- 0AOL
- 0Newsvine
- 0HackerNews
- 0Evernote
- 0MySpace
- 0Mail.ru
- 0Viadeo
- 0Line
- 0Flipboard
- 0Comments
- 0Yummly
- 0SMS
- 0Viber
- 0Telegram
- 0Subscribe
- 0Skype
- 0Facebook Messenger
- 0Kakao
- 0LiveJournal
- 0Yammer
- 0Edgar
- 0Fintel
- 0Mix
- 0Instapaper
- 0Print
- Share
- 0Copy Link





