জুলাই সনদ বাস্তবায়ন: রাজনৈতিক বিভাজন ও সাংবিধানিক সংকট বিশ্লেষণ

ভূমিকা: ঐক্যমতের সনদ থেকে বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দু

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐক্যের শীর্ষবিন্দু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। এটি ছিল একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের রূপরেখা। কিন্তু যে সনদ একসময় জাতীয় ঐক্যমত্যের প্রতীক ছিল, সেই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আজ গভীর রাজনৈতিক বিভাজনের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, সনদ বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো এবং একটি জাতীয় গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিপরীতধর্মী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ একটি পদ্ধতিগত ও সাংবিধানিক বিতর্কের আবর্তে প্রবেশ করেছে, যা পুরো সংস্কার প্রক্রিয়ার ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে মূল রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কৌশলগত অবস্থান, এর পেছনের সাংবিধানিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিশদভাবে তুলে ধরা হবে।

Read more

Table of contents

  • ভূমিকা: ঐক্যমতের সনদ থেকে বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দু
  • ১. জুলাই সনদ: বিপ্লব থেকে উৎসারিত এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত
    • ১.১ সংস্কার কমিশন এবং জাতীয় ঐকমত্যের যাত্রা
    • ১.২ অঙ্গীকারনামা: বাস্তবায়নের শপথ
  • ২. মূল বিভাজন: গণভোটের সময় ও আইনি কাঠামো
    • ২.১ দুই বিরোধী শিবির: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান
  • ৩. রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত বিশ্লেষণ
    • ৩.১ বিএনপির অবস্থান: নির্বাচনকেন্দ্রিকতা ও কৌশলগত নমনীয়তা
    • ৩.২ জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান: আইনি সুরক্ষা ও সংস্কার নিশ্চিতকরণের লড়াই
    • ৩.৩ অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা
  • ৪. সাংবিধানিক ও আইনি বিতর্ক
    • ৪.১ 'সাংবিধানিক আদেশ' বনাম 'সাধারণ অধ্যাদেশ'
    • ৪.২ পরবর্তী সংসদের 'Constituent Power'
  • ৫. উপসংহার: উত্তরণের পথ এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
Read more

১. জুলাই সনদ: বিপ্লব থেকে উৎসারিত এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত

জুলাই সনদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে এর উৎসকে বোঝা অপরিহার্য। এই সনদ কোনো সাধারণ রাজনৈতিক নথি নয়; এটি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ ফসল এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত (Political Settlement) প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া এই দলিল একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

Read more

১.১ সংস্কার কমিশন এবং জাতীয় ঐকমত্যের যাত্রা

গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া শুরু করে। এই যাত্রার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল:

Read more

১. সংস্কার কমিশন গঠন: ২০২৪ সালের অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই কমিশনগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে गहन পর্যালোচনার পর ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেয়।

Read more

২. জাতীয় ঐকমত্য কমিশন: সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে একটি দৃঢ় রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশনের মূল দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা।

Read more

৩. বিস্তৃত আলোচনা প্রক্রিয়া: জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে কয়েক মাসব্যাপী নিবিড় আলোচনা চালায়। কমিশন মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছ থেকে লিখিত মতামত গ্রহণ করে এবং তাদের সঙ্গে ৪৪টিরও বেশি বৈঠকে মিলিত হয়।

Read more

৪. ঐকমত্যের দলিল: এই দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার ফলস্বরূপ ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর খসড়া চূড়ান্ত হয়, যা একটি ব্যাপক রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে মৌলিকভাবে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল।

Read more

১.২ অঙ্গীকারনামা: বাস্তবায়নের শপথ

জুলাই সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ‘অঙ্গীকারনামা’, যেখানে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সনদ বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছে। এই অঙ্গীকারনামা কেবল কিছু প্রতিশ্রুতির তালিকা নয়, বরং এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার এক নতুন প্রকাশ, যেখানে জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছাই বিদ্যমান আইনি কাঠামোর ঊর্ধ্বে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর মূল অঙ্গীকারগুলো হলো:

Read more

• ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

Read more

• জনগণের অভিপ্রায়কে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই সনদের সকল বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা।

Read more

• সনদটিকে পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক ও আইনি সুরক্ষা প্রদান করা, যার ফলে এর বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

Read more

• ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।

Read more

• গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং উপযুক্ত সহায়তা নিশ্চিত করা।

Read more

এই দৃঢ় অঙ্গীকার সত্ত্বেও, সনদটি কীভাবে এবং কখন বাস্তবায়িত হবে—সেই প্রশ্নেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয়, যা পুরো প্রক্রিয়াকে একটি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

Read more

২. মূল বিভাজন: গণভোটের সময় ও আইনি কাঠামো

ঐক্যবদ্ধভাবে সনদে স্বাক্ষর করার পরও এর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, যা পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার হুমকি সৃষ্টি করেছে। মূলত দুটি বিরোধী শিবির তৈরি হয়েছে, যাদের মূল বিরোধের জায়গা হলো গণভোটের সময় এবং এর পেছনের আইনি কাঠামো।

Read more

২.১ দুই বিরোধী শিবির: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

গণভোটের সময় ও আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক শিবিরের অবস্থান নিচের সারণিতে তুলে ধরা হলো:

Read more
বৈশিষ্ট্যবিএনপি ও সমমনা জোটজামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও সমমনা দলসমূহ
গণভোটের সময়জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সাথে গণভোটের পক্ষে।জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে (নভেম্বর বা ডিসেম্বরে) গণভোটের দাবি।
মূল যুক্তিনির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং এতে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে।নির্বাচনের সাথে গণভোট আয়োজন জনগণের জন্য বিভ্রান্তিকর হবে। সংস্কারের আইনি ভিত্তি নির্বাচনের আগেই स्थापित করা জরুরি।
প্রস্তাবিত আইনি প্রক্রিয়াএকটি সাধারণ সরকারি প্রজ্ঞাপন বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করা।একটি শক্তিশালী 'সাংবিধানিক আদেশ' (Constitutional Order) জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করা, যা পরবর্তী সংসদকে মানতে বাধ্য করবে।
লক্ষ্যদ্রুত নির্বাচন আয়োজন এবং সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক নমনীয়তা বজায় রাখা।নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে একটি শক্তিশালী ও অলঙ্ঘনীয় আইনি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা।
Read more

এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানগুলো মূলত প্রতিটি পক্ষের গভীর কৌশলগত হিসাব-নিকাশেরই প্রতিফলন, যা তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা থেকে উদ্ভূত।

Read more

৩. রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত বিশ্লেষণ

বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার মূল কারণ বুঝতে হলে দলগুলোর ظاهری যুক্তির পেছনে থাকা কৌশলগত উদ্দেশ্য, ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।

Read more

৩.১ বিএনপির অবস্থান: নির্বাচনকেন্দ্রিকতা ও কৌশলগত নমনীয়তা

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বর্তমানে সংস্কারের আলোচনার চেয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে। তাদের কাছে সনদ নিয়ে আলোচনার বিষয়টি একটি "ক্লোজড চ্যাপ্টার"।

Read more

নির্বাচনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: বিএনপির মূল লক্ষ্য হলো যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। তারা মনে করে, নির্বাচনের আগে আলাদাভাবে গণভোট আয়োজনের প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং এটি নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে।

Read more

কৌশলগত নমনীয়তা: দলটি একটি সাধারণ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের পক্ষে, যা তাদের রাজনৈতিক নমনীয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করবে। সনদের বেশ কিছু প্রস্তাবে, যেমন—সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, বিএনপির 'ভিন্নমত' রয়েছে। তাদের কৌশল হলো, নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পেলে তারা নিজেদের ভিন্নমত অনুসারেই সনদ বাস্তবায়ন করবে। এর মাধ্যমে তারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ রাখতে চায়।

Read more

ঝুঁকির মাত্রা: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকা তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক হওয়ায় এবং দলটি পূর্ববর্তী शासকের প্রধান লক্ষ্যবস্তু না হওয়ায়, সনদ বাস্তবায়নের আইনি সুরক্ষা নিয়ে তাদের কৌশলগত ঝুঁকি জামায়াতের চেয়ে কম। এই নিম্ন ঝুঁকি উপলব্ধির কারণেই তারা সনদের সংস্কারগুলোকে আইনিভাবে সুরক্ষিত করার চেয়ে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করছে, যা তাদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের প্রতিফলন।

Read more

৩.২ জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান: আইনি সুরক্ষা ও সংস্কার নিশ্চিতকরণের লড়াই

জামায়াতে ইসলামী এবং তার সমমনা দলগুলো জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে নির্বাচনের আগেই একটি অলঙ্ঘনীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে চায়।

Read more

আইনি সুরক্ষার দাবি: তারা নির্বাচনের পূর্বে একটি শক্তিশালী ‘সাংবিধানিক আদেশ’ (Constitutional Order) জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের দাবিতে অটল। তাদের যুক্তি হলো, সাধারণ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার সম্ভব নয় এবং এর আইনি ভিত্তি দুর্বল থাকবে।

Read more

সংস্কার 'লক-ইন' করার কৌশল: ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কারণে জামায়াত সংস্কারের ফসল ঘরে তুলতে চায়। তারা আশঙ্কা করে, নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সংসদ রাজনৈতিক সমীকরণের মারপ্যাঁচে সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে বা দুর্বল করে ফেলতে পারে। তাই তারা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের মতো মৌলিক পরিবর্তনগুলোকে নির্বাচনের আগেই একটি আইনি বাস্তবতায় পরিণত করতে চায়, যা ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য মানা বাধ্যতামূলক হবে। এই অলঙ্ঘনীয় আইনি কাঠামোর ওপর জোর দেওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের উচ্চ ঝুঁকি উপলব্ধি; গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এবং ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার কারণে তারা আশঙ্কা করে যে, ভবিষ্যতে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংসদ আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করে সংস্কারগুলোকে দুর্বল করতে এবং আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সুতরাং, তাদের লক্ষ্য কেবল সংস্কারই নয়, বরং আইনগতভাবে সুরক্ষিত নিশ্চয়তার মাধ্যমে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

Read more

রাজনৈতিক চাপ: নিজেদের দাবি আদায়ে জামায়াত রাজপথের কর্মসূচিকেও একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। বড় সমাবেশের ঘোষণার মাধ্যমে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

Read more

৩.৩ অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা

রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিভাজনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছে।

Read more

মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা: ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো পক্ষই নিজ অবস্থান থেকে সরতে রাজি না হওয়ায় এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

Read more

সুপারিশ প্রদান: অবশেষে, গত ২৭ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের দুটি বিকল্প পথ উল্লেখ করে সরকারের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করে। তাদের মূল প্রস্তাব ছিল—একটি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করে গণভোট আয়োজন করা। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে পরবর্তী সংসদ একটি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কারগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।

Read more

স্বয়ংক্রিয় বাস্তবায়নের প্রস্তাব ও প্রতিক্রিয়া: বিকল্প হিসেবে প্রস্তাবে বলা হয়, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংসদ সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়, তবে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। এই প্রস্তাবটি বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, কারণ এটি নির্বাচিত সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করে বলে তারা মনে করে।

Read more

দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন অন্তর্বর্তী সরকার একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। তাদের নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তই কোনো না কোনো পক্ষকে অসন্তুষ্ট করবে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

Read more

৪. সাংবিধানিক ও আইনি বিতর্ক

রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মূলে রয়েছে একটি গভীর সাংবিধানিক ও আইনি বিতর্ক। একটি সংসদবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে রাষ্ট্রের আইনি কর্তৃত্বের উৎস কী হবে এবং কীভাবে সংবিধানের মতো একটি মৌলিক দলিলকে পরিবর্তন করা হবে—এই প্রশ্নগুলোই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে।

Read more

৪.১ 'সাংবিধানিক আদেশ' বনাম 'সাধারণ অধ্যাদেশ'

দুটি প্রস্তাবিত আইনি হাতিয়ারের মধ্যে পার্থক্যটি কেবল পদ্ধতিগত নয়, বরং এর রাজনৈতিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।

Read more

'সাধারণ অধ্যাদেশ': বিএনপির প্রস্তাবিত ‘সাধারণ অধ্যাদেশ’ মূলত বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি হাতিয়ার, যা স্থগিত সংবিধানের কাঠামো থেকে সীমিত কর্তৃত্ব লাভ করে। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আইন প্রণয়নের একটি প্রচলিত পদ্ধতি হলেও, সংবিধানের মতো সর্বোচ্চ আইন সংশোধনের জন্য এর ক্ষমতা ও বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ।

Read more

'সাংবিধানিক আদেশ': বিপরীতে, জামায়াত ও তার মিত্রদের প্রস্তাবিত ‘সাংবিধানিক আদেশ’ একটি বিপ্লবী দলিল হিসেবে বিবেচিত, যা তার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব লাভ করে সরাসরি গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া ‘জাতীয় ঐকমত্য’ থেকে। এটি জনগণের ‘Constituent Power’ বা সংবিধান প্রণয়ন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, যা পুরনো সাংবিধানিক ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে এবং নতুন সাংবিধানিক বাস্তবতা তৈরি করতে সক্ষম। এর ভিত্তিতে আয়োজিত গণভোট একটি শক্তিশালী জনম্যান্ডেট তৈরি করবে, যা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ কোনোভাবেই পাশ কাটাতে পারবে না। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্কার বাস্তবায়নের নজিরকে তারা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে।

Read more

৪.২ পরবর্তী সংসদের 'Constituent Power'

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদকে একটি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে, যার হাতে ‘Constituent Power’ বা ‘সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা’ থাকবে। এর অর্থ হলো:

Read more

• গণভোটের মাধ্যমে জনগণ শুধু সংস্কার প্রস্তাবগুলোকেই অনুমোদন দেবে না, বরং পরবর্তী সংসদকে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি বিশেষ ও অস্থায়ী ক্ষমতাও প্রদান করবে।

Read more

• এই ক্ষমতা একটি সাধারণ আইন প্রণয়নকারী সংসদের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এর মাধ্যমে সংসদ জুলাই সনদের আলোকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আনার বৈধতা পাবে।

Read more

এই আইনি বিতর্কটি বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার সমাধান নির্ধারণ করবে দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি।

Read more

৫. উপসংহার: উত্তরণের পথ এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

যে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলন ২০২৪ সালে জুলাই সনদকে সম্ভব করেছিল, সেই ঐক্য আজ বাস্তবায়নের প্রশ্নে এসে ভেঙে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন একটি উভয়সংকটের মুখোমুখি: একদিকে বিএনপির নির্বাচনকেন্দ্রিক বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যা দ্রুত নির্বাচন চায় কিন্তু সংস্কারের চূড়ান্ত রূপ ভবিষ্যৎ সংসদের হাতে ছেড়ে দিতে আগ্রহী; অন্যদিকে জামায়াতের আইনগতভাবে সুরক্ষিত সংস্কারের দাবি, যা নির্বাচনের আগেই সংস্কারগুলোকে একটি অলঙ্ঘনীয় আইনি ভিত্তি দিতে চায়।

Read more

এই বিভাজনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো মারাত্মক। সরকারের যেকোনো একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে অথবা রাজপথে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে, একটি দুর্বল আইনি কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে তা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, যা এই ঐতিহাসিক সংস্কারের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সব মিলিয়ে, জুলাই সনদকে ঘিরে তৈরি হওয়া এই রাজনৈতিক বিভাজন বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।

Read more

Did you like this story?

Please share by clicking this button!

Visit our site and see all other available articles!

Abu Sayed | Laravel, Unity & AI Expert - Developer & Musician from Bangladesh