২০২৫ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একের পর এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড ও বিপর্যয়ের শিকার হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রগুলোতে এই ধারাবাহিক আঘাতের ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। দেশের সাধারণ মানুষের মনে আজ একটিই প্রশ্ন: এটা কি শুধুই ভয়াবহ দুর্ঘটনার এক অবিশ্বাস্য সমাপতন, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র?
এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন বিশ্লেষণ এক উদ্বেগজনক সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন এই ঘটনাগুলো আসলে দেশের অর্থনীতির ওপর একটি সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত হামলার অংশ হতে পারে। এই লেখায় আমরা সেই যোগসূত্রগুলো উন্মোচন করব এবং দেখাব কীভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরি করে।
এই অর্থনৈতিক হামলা শুরু হয়েছিল ১৪ই অক্টোবর, এবং পরবর্তী দিনগুলোতে তা দেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত খাতগুলোর ওপর যেভাবে আঘাত হানা হয়েছে, তা এক ভয়ংকর পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। ঘটনাগুলোর ক্রম এবং লক্ষ্যবস্তু বিশ্লেষণ করলে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা নকশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই রপ্তানি-সম্পর্কিত শিল্পকে লক্ষ্যবস্তু করা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ। এগুলোকে কি শুধুই দুর্ঘটনা বলা যায়, নাকি প্রতিটি আঘাতের লক্ষ্যবস্তু ছিল পূর্বনির্ধারিত?
বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই ধারাবাহিক হামলার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আঘাত হানা। বৈদেশিক রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন, যা দিয়ে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করা হয়। এই রিজার্ভকে দুর্বল করার জন্য একটি 'দ্বিমুখী ক্ষতি' (double loss) কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড এই কৌশলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেখানে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই পণ্যগুলো সাধারণ কোনো পণ্য ছিল না; এর বেশিরভাগই ছিল পোশাক ও ওষুধ শিল্পের জন্য আমদানি করা অতি জরুরি কাঁচামাল। এমনকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা বিশেষ সরঞ্জামও এই আগুনে পুড়ে যায়। অর্থাৎ, দেশ ডলার খরচ করে যা কিনে এনেছিল, তা তো ধ্বংস হয়েছেই, আবার সেই কাঁচামাল ব্যবহার করে যে রপ্তানি পণ্য তৈরি হতো এবং নতুন ডলার আসতো, সেই পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এটি একটি নিখুঁত অর্থনৈতিক চোরাগোপ্তা হামলা: একদিকে দেশের সিন্দুকে থাকা সম্পদ ধ্বংস করা, অন্যদিকে সেই সিন্দুক নতুন করে ভরার পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া।
বিমানবন্দরের ঘটনাটি এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আরও জোরালো করে তুলেছে, কারণ এর পেছনের প্রেক্ষাপটটি অবিশ্বাস্য।
এই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের মাত্র এক সপ্তাহ আগে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (DFT) থেকে ১০০-তে ১০০ নম্বর পেয়ে একটি নিখুঁত রেটিং অর্জন করে। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। এই স্বীকৃতির ফলে ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি কার্গো পাঠানোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা উঠে যায়। এর অর্থ ছিল, রপ্তানিকারকদের আর ভারত বা অন্য দেশের মাধ্যমে ব্যয়বহুল ট্রান্স-শিপমেন্টের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এটি ছিল দেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং জাতীয় গর্বের জন্য এক বিরাট বিজয়।
এখানেই জন্ম নেয় বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন: যে স্থাপনাকে মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য বিশ্বজুড়ে পুরস্কৃত করা হলো, যার সাফল্যের ആഘോഷের রেশ কাটতে না কাটতেই, সেই স্থাপনার হৃৎপিণ্ড কীভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেল? এই বৈপরীত্য কোনো দুর্ঘটনা তত্ত্বকে দাঁড়াতে দেয় না।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, বিমানবন্দরের আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল ব্যর্থতা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার দিকে ইঙ্গিত করে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেই মনে করেন, এই বিলম্ব এবং ব্যর্থতাগুলো ছিল ইচ্ছাকৃত। তাদের মতে, ফায়ার সার্ভিসকে যদি সাথে সাথে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো, তবে বিপুল পরিমাণ পণ্য বাঁচানো সম্ভব ছিল। অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, কেউ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে চেয়েছিল "সর্বোচ্চ ধ্বংস নিশ্চিত করতে" বা আগুনকে "পুড়তে দিতে"।
যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই ঘটনাগুলো একটি পরিকল্পিত হামলা, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কাদের লাভ? সূত্রগুলো কয়েকটি রাজনৈতিক তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করে।
এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক স্তম্ভগুলোর ওপর এই ধারাবাহিক আঘাতের ধরণ, বিমানবন্দরের নিখুঁত নিরাপত্তা রেটিং পাওয়ার পরপরই সেখানে ঘটা বিপর্যয় এবং আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ব্যর্থতা—এগুলো কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। উত্তরহীন প্রশ্নগুলো এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
এই লেখাটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নয়, বরং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্য। প্রশ্নটি সহজ: যখন একটি দেশের ভিত্তিই আগুনে পুড়তে থাকে, তখন সেই আগুন নেভানোর জন্য কার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়?
Please share by clicking this button!
Visit our site and see all other available articles!